আজ (০১ এপ্রিল, ২০১৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের অডিটোরিয়ামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে “বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ও মাদকাসক্তি : বর্তমান পরিস্থিতি ” শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট এমন হয়েছে যে, আমরা যা জানি আমরা তা মানি না,আবার আমরা যা বলি তা বিশ্বাস করি না, আবার যা বিশ্বাস করি তা বলি না। এ যেন নিজের সাথে নিজেকে লুকোচুরি করা। এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আজ দেশের উন্নয়ন, দুর্নীতি, মাদক, ধ্বংস আবার সৃষ্টি যেন একই সূত্রে গাঁথা। একটার সাথে আরেকটি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে।
দুদক চেয়ারম্যান তাঁর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আট-দশ দিন আগে মৃত এমন একটি মেয়ের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর। সেখানে যেয়ে আমি জানলাম, মেয়েটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তবে মেয়েটি নেশা করতো। মাদকাসক্ত আর হতাশা থেকেই আত্মহত্যা । পৃথিবী থেকে করুণ বিদায় নিয়েছে সে।
তিনি তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আজ তোমাদের কাছে ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে। আমরা যখন দেখি এই ফেসবুকে সম্ভাবনাময় কোনো তরুণ সকালে প্রেম করছে, দুপুরে ফেসবুকে বিয়ে এমনকি ঐ ফেসবুকেই অনাগত সন্তানদের সম্ভাব্য নাম রাখা হচ্ছে, তারপরই ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রেম। অর্থাৎ প্রেম, বিরহ, নেশা তারপর চরম হতাশা এবং জীবন নামক স্বপ্নের মৃত্যু। আমরা হতাশায় নিমজ্জিত এমন প্রজন্ম সৃষ্টি হোক তা চাই না। সিদ্ধান্ত তোমাদেরই নিতে হবে।
তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ফিরে আসলে মনে হয় নিজ গৃহে ফিরে এসেছি। দেশের যে কোনো সংকটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে পথ দেখায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শেষ আশ্রয়স্থল।
কিন্তু অপ্রিয় একটা সত্য কথা বলি আমরা যখন ২০১৬ সালে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করি তখন জানতে পারি, আমাদের প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও কতিপয় শিক্ষার্থীও মাদকের মরণ নেশার সাথে জড়িত। জাতির এই শেষ আশ্রয়স্থলেও যদি নেশা চলে আসে, তবে আমরা যাব কোথায় ? ।
একসময় সিভিল সার্ভিসসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদের চাকরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই প্রাধান্য পেত। সে অবস্থাও ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। যদি নেশা থাকে তাহলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না। আমিতো অনুপ্রাণিত হই যখন দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে , এতে আমরা গর্ববোধ করি। কারণ এই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ই ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে মহান মুক্তিযদ্ধের সুতিকাগার হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। তাই আমি তোমাদের একজন অগ্রজ হিসেবে অনুরোধ করবো, তোমরা নেশার পঙ্কিল জগতে প্রবেশ না করে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মেধা বিকাশে নিজেকে আত্মনিয়োগ করবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নেতৃত্ব তোমরাই দিবে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
তিনি বলেন, দুদক আইন অনুসারে মাদক সংক্রান্ত অপরাধ আমাদের আওতাভুক্ত নয়। তারপরও আমরা মাদক ব্যবসার মাধ্যমে যারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছে তাদের তালিকা চেয়েছিলাম মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে নিকট। তারা প্রথম যে তালিকা দিয়েছিল তাতে তিন শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীর নাম দিয়েছিল। কিন্তু অনুসন্ধান করতে যেয়ে দেখলাম তাদের সাথে ঠিকানার কোনো মিল নেই। আমরা আবার তাদের কাছে তালিকা চাইলাম , তারা আবার তালিকা দিল। এই তালিকা অনুসন্ধান করে আমরা এ যাবৎ ১২ জনকে প্রসিকিউট করেছি। কমিশনের মামলায় কেউ কেউ কারাগারেও গিয়েছেন । আমরা বার বার বলছি , মাদক , দুর্নীতি, সন্ত্রাস এগুলো নিয়ন্ত্রেণে ব্যপক গণসচেতনতার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সমন্বিত এবং সম্মিলিত উদ্যোগেরও কোনো বিকল্প নেই। আমরা উন্নয়ন করছি একথা সত্য, তবে মাদক এবং দুর্নীতি নির্মূল না করে উন্নœয়ন করলে তা টেকসই নাও হতে পারে।
তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেন, আসুন আমরা মাদককে না বলি, আমরা দুর্নীতিকে না বলি, আমরা আমাদের মেধা ও মননের সর্বোচ্চ বিকাশ স্াধন করি । আগামী দিনের সুন্দর বাংলাদেশের নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতা অর্জন করি। এই হোক আজকের অঙ্গীকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতর এর পরিচালক অধ্যাপক ড. মেহ্জাবীন হক এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা মানস এর সভাপতি অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী । মূল প্রবন্ধে ড. চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, বর্তমানে মাদকাসক্তোদের পরিসংখ্যানের কোনো তথ্য না থাকলেও বেসরকারিভাবে দেশে ৭৫ লাখের বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে এবং এসব মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তাদের ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
একটি পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রবন্ধে বলা হয়েছে , মাদকসেবীরা গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে থাকে। অর্থাৎ মাসে ৬০০ কোটি টাকার মাদক ব্যবসা হয়।